আসমা রানী
ভোরের পাখির ডাক শুনেই ঘুম ভাঙে প্রতিদিন,পশ্চিমের জানালা খুলতেই চোখজুরে ভেসে উঠে ভাসমান নদীর রূপময় দৃশ্য।ঘরে বসে থাকা হয়না আমার, ছুটে যায় নদীর টানে ঘর থেকে বাইরে। একা একা খুব কাছে থেকে নদীর সৌন্দর্য লীলা উপভোগ করতে,খালি পায়ে হেটে বেড়াতে কোমল দূর্বাঘাসের ছোঁয়া নিতে।
মিষ্টি সুরে ভোরের পাখি যখন গান গেয়ে বেড়ায় আমিও তখন মনের অজান্তে সুর মিলিয়ে গুণগুণ গেয়ে বেশ আনন্দই পাই। নদীর স্রোতবয়ে বেড়ায় ক্লান্তিহীন নদীর পার বেয়ে নাম নাজানা কতশত ঔষধি গাছ মনভরে দেখি আর ভাবতে থাকি দাদুর কথা -ছোটবেলা দাদুর কাছে শুনতাম নদীর পানি পান করলে নাকি অনেক রোগমুক্ত হওয়া যায়।
খুব আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করতাম কি বলো দাদু নদীর পানি কি ঔষধ নাকি! দাদু হেসে হেসে উত্তর দিতো হ্যারে হ্যা একশো একটা গাছের শেকড় ধুয়ে নদীতে নামে নতুন পানি, আর এই একশো একটা গাছই ঔষধি গাছ আর তাই এ নদীর পানিও ঔষধ।খুব মনে পরছে দাদুর সেই কথাগুলি আজ দাদু নেই আর এই নদীর পানিও এখন আর ঔষধ নেই এ নদী আজ নোংরা ময়লাযুক্ত নর্দমা হয়েই গেছে প্রায়।
তবুও আসি তৃপ্তি নিতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পাখিডাকা ভোরবেলায়, মাঘের শেষপ্রায় হালকা শীত লাগছে শিশিরভেজা দূর্বাঘাসের স্পর্শ পেয়ে দেহমনে শীতলতা বইছে কুলঘেষেই হাটছিলাম এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে সুখনিচ্ছিলাম হঠাৎ ওপাড়ে নজর গেলো ওই তো শিমুল গাছটায় কি যেন ঝুলে আছে মনে হচ্ছে এখনো সূর্য্য উকি দেয়নি পূর্বের আকাশে হালকা অন্ধকারে বুঝা যাচ্ছেনা ঠিক, আমি খুব করে খেয়াল করলাম বুঝতে পারছিনা কিছুই জানার আগ্রহ একটু বেশিই আমার কৌতুহলী মন,হালকা পানি আছে নদীতে পুরোপুরি শুকায়নি এখনো হাটু নাগাদ ভিজতে পারে ভেজা ব্যাপার না তবে জানতে হবে ওটা কি ঝুলে আছে শিমুল ডালে।
শাড়িপরিহিতা ছিলাম একটু উপরে ওঠিয়ে নেমে গেলাম নদীতে,কাছাকাছি যেতেই মনে হলো কোন মানুষ ঝুলে আছে ।হ্যা তাইতো – আরে এতো শিউলি , হ্যা শিউলিই তো,অজানা একটা কষ্ট বুকের ভেতর মুচড় দিলো, জোরেশোরেই একটা চিৎকার দিলাম।আশপাশ এখন আলোর ঝিলিক দিচ্ছে গ্রাম্য বধুরা উঠান ঝাড়ু দেওয়াই ব্যস্তই ছিল আমার চিৎকার এ দৌরে ছুটে এলো লোকজন, মাঝবয়সী রোগাটে একলোক এসে চিৎকার দিয়ে জড়িয়ে ধরলো লাশটা-এইডা তুই কি করলি মা- মারে মা তুই কথা ক, কথা ক মা কথা ক।
কান্নায় লুটিয়ে পড়ছে লোকটা, ভাষা জানা নেই আমার এই মেয়েহারা বাবাকে শ্বান্তনা দেয়ার।তাকিয়েই আছি অবাক চোখে, এইতো কয়েকদিন আগের কথা এই মেয়েটি ভরাবর্ষায় নদী সাঁতরে আমার জন্য শাপলা ওঠিয়ে নিয়ে আসতো চিংড়িমাছ দিয়ে শাপলার ডগা খেতে আমি পছন্দ করতাম সেটা জেনেই আমায় ভালোবেসে শাপলার ডগা উপহার দিতো প্রতিদিন, আমি সাতার জানতামনা তাই আমাকে সাতার শেখাতে চাইতো আমি ভয় পেতাম নদীতে নামতাম না সে মনের সুখে সাঁতরাত আর আমি প্রাণ ভরে দেখেই তার স্বাদ নিতাম।
খুব কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্য বুকের ভিতর অজানা ব্যথা অনুভব করছি,আমার সাথে দুইমাস গতহলো দেখা নেই।অভিমান করেই আমার সামনে আসেনা,দুই মাস আগে একসকালে আমার গায়ে জ্বর ছিল সেদিন সকালে আমায় নদীর পাড়ে না পেয়ে চলে এসেছিল আমার বাড়িতে শাপলার ডগা,আর কলমি শাক নিয়ে।খুব কান্না করেছিল সেদিন আমায় জড়িয়ে ধরে বলেছিল ওর বিয়ে হয়ে গেলো আমায় কে শাক তুলে দিবে আমার জন্য নাকি ওর মায়া হয়, ঘরে সৎমা অভাগীটা জন্মের সময়ই মা হারিয়েছিল গরীব বাবা ততোটা দেখভাল নিতে পারেনি মেয়েটার।
আমায় বিয়েতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলো দুর্ভাগ্যবশত সেদিন আমার পরিক্ষা ছিল যাওয়া হয়নি ওর বিয়েতে।এরপর দুইবার গিয়েছিলাম আমি ওর বাড়িতে, সামনে আসেনি আমার অভিমানী মেয়েটা।নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ঝুলে থাকা লাশটার দিকে কষ্টহচ্ছে তবুও সামলে নিয়ে ওর বাবার কাঁধে হাত রাখলাম-
কি হয়েছিল ওর কাপাস্বরে প্রশ্ন করলাম ‘বিয়ার সময় একটা গাইগরু(গাভী) দিয়াদিছিলা আর দুইডা হাতের বালা জামাইরে দশহাজার ট্যাহা,অইনাই হেগর মা মরা মাইডারে কি অত্যাচার ই না করছে খালি ট্যাহা আর ট্যাহা, আর একটা ভালা কথাও কয়নাই মাইয়াডার লগে,কাইলরাইতে মাইয়াডারে মাইরাধইরা আইন্যা রাইখ্যা গেছে, মাইয়া আমার সারাডা রাইত কাইন্দা পার করছে শেষ রাইতে আমি যহন ঘুমাইছি তহন মায় আমার….আর বলতে পারলো না মাটিতে লুটে পরলো অসহায় বাবা নামের রোগা এই মানুষটা চোখেরজল ধরে রাখা সম্ভব হয়নি আমার আমিও কেঁদে ফেললাম লোকটাকে জড়িয়ে ধরে।
বেলা প্রায় দশটা বেজে গেছে থানা থেকে পুলিশ চলে এসেছে লাশ নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ময়নাতদন্ত করবে বলে, অসহায় বাবা নাহ— নিবেন না আমার মাইয়াডারে কাইট্রা ছিড়া কষ্ট দিবেন না অরে আর — অভাগী মা আমার জন্ম থেইক্যাই কষ্ট পাইতাছি,আমার কোন অভিযোগ নাই কোন বিচার চাওয়ার নাই কারোর বিরুদ্ধে, আফনেরা রাইখ্যা যান আমার মাইয়াডারে রাইখ্যা যান রাইখ্যা যান।
পুলিশের গাড়ি চলে যাচ্ছে শিউলির লাশ নিয়ে অসায় বাবার কান্নার সুরে ভারী হচ্ছে চারপাশ বাতাস থমকে যাচ্ছে, পাখির ডাক বন্ধ হচ্ছে, আমার মতো নদীর ও নিশ্বাস অভিমান ভাঙা হলোনা আর ক্ষমা করে দিও শিউলি ভালো থেকো ওপারে –নদীর পাড়ের মেয়ে…….।